চার কোটি মানুষের ভিড়‒ তবু মনে হয় খাঁখাঁ বিরানভূমি এ জনপদ

 আমরা তিন ভাইবোন। শিউলির পরে আমি, তারপর ছোট বোন শিল্পী। ছোটবেলায় শিউলি ছিল দাদির পাগল। এত পাগল যে, ওকে ছাড়া দাদি কোথাও যেতে পারত না। খেতে পারত না। পাড়া বেড়াতে পারত না। দাদিকে না পেলে শিউলির যে বিলাপ শুরু হতো তা দেখা যায় না। ছটফট করত। কী যে কান্না করত বলে বোঝানো যাবে না। একবার দাদি শিউলিকে রেখে বাপের বাড়ি বেড়াতে যায়। স্কুল ফেরত শিউলি এসে দাদিকে না দেখে সেই যে কান্না জুড়ল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা-রাত অব্দি। সারা বিকেল ওকে কেউ থামাতে পারেনি।


আমাদের গোরস্তানের পথ ধরে মাঠের রাস্তা। তারপর বড় রাস্তায় মিশে দাদির বাপের বাড়ির পথ। শিউলি দাদির বিলাপে সারা বিকেল ওই পথে ছুটে ছুটে যায়; কেউ ধরে এনে শান্ত করে; কিছুক্ষণ পর আবার পথ ধরে দৌড় দেয়। ‘ও দাদি, ও দাদি…’ সারা বিকেল-সন্ধ্যা এভাবে চলেছে। বিকেলে ওকে কাঁদতে দেখে খেলতে গিয়েছি; মগরেবের সময় এসে শুনি সে আবার মাঠের রাস্তায় দৌড় দিয়েছে দাদির কাছে যাবে। ইদগাহ অব্দি যেয়ে দেখি সে প্রায় বুধোর বাড়ি বড় রাস্তার কাছাকাছি। ওর পাগলপ্রায় দৌড়ানি; দাদি, দাদি বলে চিল্লানো দেখে আমার হাসিই পেল। ওকে ব্যঙ্গ করে মনে মনে বললাম, ‘আমারও তো দাদি। আমি তো দাদিকে ছাড়া দিব্যি থাকতে পারি। বাড়িতে আব্বা আছে, মা আছে; আমরা ভাইবোনেরা আছি। তোর দাদিকে লাগবেই কেন!’ দাদিই ওর পুরো দুনিয়া। বোকা মেয়ে!

কেমন মায়া হলো ওর প্রতি! দাদির প্রতি রাগ হলো। কেন মেয়েটাকে সে না নিয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি!

কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে। সম্ভবত আরও বেশি। দাদি আজ নেই। শিউলির ছেলেটা ক্লাস এইটে। আজ যদি ওকে বলতে পারতাম, ‘বু’জান আমার! একটা মানুষ মানুষের হতে পারে পুরো দুনিয়া।’ বুজান, কার কাছে যেয়ে বলব, কোন পথে দৌড়ে করব এ বিলাপ!

‘বু’জান আমার! তোকে ব্যঙ্গ করার পাপেই কি আজ খোদা আমার দুনিয়াটা কেড়ে নিল! দাদির মতো একজনই কেবল নেই; চার কোটি মানুষের ভিড় তবু মনে হয় খাঁখাঁ বিরানভূমি এ জনপদ। ‘ও বু’জান! আমাকে একটাবার জড়িয়ে ধর আজ।’

 

তবু হৃদয় শান্ত আর ধীর

 জুতো কেনার জমানো টাকা দিয়ে মদ কিনে ঘরে ফিরলাম। কেরানি জীবনে নবাবি বলতে দর কষাকষি ছাড়াই রিকশায় চেপে বসা আজিমপুর যাবেন?

জানালার সুন্দর সাদা পর্দা, চকচকে দেয়ালের রং, বেতের সোফা এমনিতেই ছোট ঘর, এতকিছু ঢুকে পড়লে নিজের জায়গাটুকু থাকে না। পয়সা কোথায় সেসব কেনার? নেই। আসবাবহীন ঘরটাকে নিজের বলে মনে হলো। ইচ্ছে হলে সিগারেটের ছাই ফেলানো যায়, গেলাসে ঢালা যায় লাল জল, চিপসের প্যাকেট ছুড়ে ফেলা যায় মেঝেতে যেন ছুড়ে ফেলছি ছোটলোক বলে অবহেলা করা তোমারই সে পুরোনো চিঠি। জন্মদিনে আমাকে লেখা হয়েছিল ‘ভালো বন্ধু।’

দুই গেলাস শেষ হলো। মাথা এলোমেলো হয়ে আসছে। তবু হৃদয় শান্ত আর ধীর। সব টের পাচ্ছি মনে হলো এখনও তোমারে ভালোবাসি সব অপমানের পরেও। পিঠের দেয়াল থেকে বেরিয়ে এলো তোমারই ছোটবোন। আমারে সঙ্গ দিতে। বললাম, বেদুইন জীবনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিয়ম করে ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষাই তো প্রেম। এখনও জমে আছে হৃদয়ে। আমার কথাবার্তা পাত্তা পেলো না। ‘তুমি একটা বাজে লোক। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো।’

আয়নায় নিজেরে দেখলাম পৃথিবীর সবচে সুন্দর চিত্রনাট্য প্লে করা হলো।

বৈশাখের খা খা ভোরে আমার জন্ম। আজান হচ্ছিলো সম্ভবত। সকালের রোদ তীব্র হওয়া অব্দি সবাই আমাকে ঘিরে ছিল। দমবন্ধ লাগছিল। বাবাকে দেখলাম না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। মায়ের জন্যে মন খারাপ হলো। ততক্ষণে হারিয়ে গেছে বাড়ির পথ। আমি বড় হয়ে গেছি মা টেরই পায়নি। রাস্তা খুঁজে হয়রান হলাম। ক্লান্তিও লাগছিল। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। খিদে পাচ্ছিল। সাদা ভাত, ডাল আর নরম বিছানার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হাঁটছিলাম। কেবলই হাঁটছি।





ঠিকানা জানি না তবু থামলাম। নক করলাম। দরজা খোলা হলো। যেন অবগত আমি আসব। তবু বসতে বলা হলো না। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিচেনে রাখা আছে ভাত-ডাল? সেখানে গেলাম। এঁটো বাসন-কোসন পড়ে আছে। থালার অভাবে ভাত খেতে দেয়া যাচ্ছে না ভাবলাম। ক্লান্ত তবু ধুয়ে ফেললাম। বড় থালা। ফুলের ছবি চারপাশ জুড়ে। ভাত বলে মনে হতে লাগল। খিদেও পেয়েছে বেশ। কারও মনোযোগ পাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। মনে হলো খুব ভিড়ের ভিতর হারিয়ে ফেলেছি মায়ের হাত ‘আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও। খিদে পেয়েছে আমার। বাড়ি গিয়ে ভাত খাব।’

কেউ শুনলো না। স্ক্রিন চালু হলো। সুর শুরু হলো। সিনেমা শুরু হলো কাজলের দিনরাত্রি।

আমার ক্ষুধার হাহাকার ঢাকা পড়ে গেল। ট্যাপের জলের সাথে মিশে যদি হারিয়ে ফেলা যেত নিজেরে পাতালপুরির দেশে! জলের সাথে নিজেরে মিশিয়ে দিলাম।

সবুজ পুরোনো দেয়াল-ঘেরা ঘরে নিজেকে টের পেলাম। সকাল হয়ে গেছে। বাইরে ঘন কুয়াশা। ক্ষুধা আর কেরানির জীবন নিয়ে উঠে পড়লাম। একই কিচেন। একই জলের ট্যাপ। সেই ঘর যেখানে পৌঁছেছিলাম ঠিকানা না জেনেই। উঠে পড়তে হলো। যেন কেউ দেখে না ফেলে! জল গরম করে তড়িঘড়ি স্নান সারলাম। বিষাদের শরীরে গরম জল আহা। লাল জলের কথা মনে হলো। মনে হলো বেরিয়ে পড়তে হবে।

মদ গেলার ঘটনা মনে পড়ছে না। আসবাবহীন পুরোনো ঘরটা নেই। বোতলটা উধাও।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই সকাল মাঝের কিছুই মনে পড়ছে না। জুতো কেনার আকাঙ্ক্ষা, কেরানি জীবন, মদের বোতল কিছুই মনে পড়ছে না। কেবল টের পেলাম ক্ষুধা।

বেরিয়ে পড়লাম।

 

যাযাবর/২০ পৌষ, ১৪২৯

যীশুর পুনরুত্থান

 




একজন ক্রীশ্চন যেভাবে বিশ্বাস করে— যীশু ফিরে এসেছিল

বাবাও আসবে ফিরে বিশ্বাস করে আড়াই বছরের শিশু
বাবা তার পা হারিয়ে নিরুদ্দেশে
মা তার ঘুমের ঘোরে পুরনো প্রেমিক পোষে।
বহুগামী রাষ্ট্রে হারিয়ে গেলে ফিরে আসে না কিছুই জানে ওই বুড়ো
পুত্রের শোকে যার যায় দিন
স্ত্রীর ক্যান্সার সারবে না জেনেও যেভাবে
মিথ্যের বেসাতি বাড়িয়ে একদিন
বুড়োটা মরবে শিশুটির মায়ের ফুরোবে যৌবন
বাবা আর ফিরবে না ফিরবে না
বড় হয়ে জানবে সে
অথচ একদিন সবই ছিল
পৃথিবীতে ছিল রোববার যীশুর পুনরুত্থান
বড় হয়ে জানবে সে ভালোবাসা এক ভয়ংকর মিথ আর
একদিন পৃথিবীতে প্রেম ছিল।

আমি কি তবে বেঁচে আছি? তবে কি ওঁরা আমাকে মৃত ঘোষণা করলো?

আমি জানি না, আমার অনুপস্থিতিতে আমার সন্তানদের কী অনুভূতি হয়

আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আমাকে নিয়ে কী চিন্তা করেন

মা কাঁদেন কিনা

বাবা দুঃখ করেন কিনা

বন্ধুরা কী সমালোচনা করেন

কমরেডগণ প্রেসের কাছে কী বিবৃতি দেন

সহকর্মীরা আমার ফিরে আসার প্রত্যাশা করেন কিনা


আমি জানি না, তাঁদের কে কী ভাবেন, কী চিন্তা করেন, কার কী দুঃখ বোধ হয়

কিন্তু আমি সবার বিষয়ে জানি আর জানি, আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।


খুব ব্যস্ততার দিনে ধরুন, বুধবারের সকালে।

সন্তানেরা কাঁদছে। স্ত্রী বিলাপ করছে। মা কাঁদছেন অঝোরে। বাবা ঈশ্বরের প্রতি বিরক্তি জানালেন কেন তাঁর আয়ু নিয়ে আমাকে আরও, আরও কয়েকবছর জীবন দান করা গেল না।

বন্ধুদের কেউ ভক্ষণযোগ্য রোস্ট মুখে পুরে দিয়ে যেভাবে বিরোধী দলের সমালোচনা করা হয় সেভাবে কিছু পয়সা পাওয়া যেত। মৃতের ঋণ মওকুফ পুণ্যের কাজ বলে গোরখনন কমিটিকে তলব করলেন একজন। সহকর্মীদের কেউ এত তাড়াতাড়ি! বড্ড তাড়া আমার বলে দুঃখই করলেন বোঝা গেল।

শৈশবের প্রিয় বন্ধুর চোখে জল নেই। কীভাবে আরও সুন্দরভাবে কবরটি খোঁড়া যায় তদারক করছে। একজন ইমামকে আনতে গেছে। বরই পাতা, গোলাপ জল নিয়ে ব্যস্ত কেউ কেউ।

কয়েকজন কমরেড এসেছেন। মুখের পর্দা সরানো হলো আমার দিকে তাকালেন। দুজনের চোখের কোনায় জল। তিনজন প্রতিবেশীদের সাথে দাফন নিয়ে আলাপে আগ্রহী হলেন।

গোসল সম্পন্ন হয়েছে। জানাযার আগে ছোট চাচা জানালেন, পাওনা তাঁর কাছে চাইতে।

নিজের কাছে আমারও কিছু পাওনা ছিল।


[আমি ছিলাম ঘুমকাতুরে। তার জন্যে মা আমাকে বকতো খুব। বাবা বলতো, আমার কখনও উন্নতি হবে না। ঘুমের জন্যে ক্যারিয়ার, ঘুমের জন্যে সংসার, ঘুমের জন্যে স্ত্রীর সাথে বিরোধ, সন্তানের অভিমান আরও কত কী! এমনই এক বুধবারের সকাল নটায়; আমি ছিলাম ঘুমে কান্নার শোরগোল।]

রাতের ব্যাকপেইন কিছুটা আছে। তার মানে? আমি মরিনি?

আমি কি তবে বেঁচে আছি? তবে কি ওঁরা আমাকে মৃত ঘোষণা করলো?


দেহটাকে শুইয়ে রেখে আমি বাইরে এলাম। সিগারেট ধরালাম। সবকিছু কেমন স্বাভাবিক লাগছে। তবে কি আমি সত্যিই মরিনি? স্ত্রীর ঘরে গেলাম। অফিসে চলে গেছেন।

নিজের বসকে ফোন দিলাম। টাইম ম্যানেজমেন্ট যার নেই তার আর চাকরি নেই বলে তাঁর পিয়ন জানালো

তবে কি আমি জীবিত? নাকি মৃত? নাকি মরে গেছি বহুকাল আগে? নাকি আজ? বুধবারের সকালে। নাকি মরিনি? আমি কি তবে জীবিত?

ক্ষুধা লাগেনি। তবে কি বেঁচে আছি? আত্মাকে যে শুইয়ে রেখে এলাম নিজের ঘরে

নিজের ঘরটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কি আমার নিজের কোনো কামরা ছিল না?

আকাশে ঘোর অন্ধকার। মেঘেদের শোক। তবে কি সত্যিই আমি আর বেঁচে নেই? আমার চোখের জল? তা-ও তো নেই। তবে কী? আমি জীবিত? নাকি মৃত? নাকি মরে গেছি বহুকাল আগে? নাকি অন্যকিছু? বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। ঈশ্বর, আমি কি বেঁচে আছি? তবে আমার প্রার্থনা কবুল করো। আমাকে মিশিয়ে দাও বৃষ্টির ফোঁটায়। শেষ প্রার্থনাটুকু মঞ্জুর করো, প্রিয় ঈশ্বর।

কিংবা আমাকে জানাও, আমি জীবিত। আমি মরিনি। আমি বেঁচে আছি।


২রা ফেব্রুয়ারিঃ শিক্ষার সওদায় রাবি প্রশাসনের নগ্ন চেহারা

গুলিতে আহত শিক্ষার্থী


২রা ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের আজ ১১ বছর। হামলাকারী প্রশাসন ও তার সহযোগীদের করা ছয়টা মামলা এখনও চলমান। বিজ্ঞ আদালত ইতোমধ্যে দুটো মামলায় ছাত্রদের পক্ষে রায় দিয়েছে বলে জেনেছি। টিউশন ফি প্রত্যাহার আর পয়সার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সের সনদ বিক্রির পাঁয়তারা রুখে দিতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিলো সেদিন। পাঁচ সহস্রাধিক ছাত্রের সেই বিক্ষোভ থামাতে গুলি ছুড়েছিলো তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়েস তখন তেতাল্লিশ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাইভেটাইজড করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ছাত্ররা বিক্ষোভ করছিলো সেদিন। কিন্তু প্রশ্নটা যে সওদাগিরির! পয়সা কামানোর! পয়সার প্রশ্নে তাই ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দিতে ভুল হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। পুলিশ আর ছাত্রলীগকে দিয়ে ঘৃণ্য হামলা চালায় নিরীহ ছাত্রদের উপর। ব্যাপক হামলা, ছররা বুলেট, রাবার বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয় ছাত্রদের পিঠ। ১২ জন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়, আহত হয় শতাধিক। [প্রকৃতপক্ষে, হতাহতের সংখ্যা কয়েকশো বলে ধারণা করা হয়]

হামলা থেকে নিজেদের বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে শিক্ষার্থীরা
শিক্ষার সওদাগর ততকালীন প্রশাসনের নগ্ন চেহারা উন্মোচিত হয়েছিলো সেদিন, ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ তারিখে। দিবসটির আজ সাত বছর। বিগত ছয় বছর ধরে দিবসটিকে শিক্ষা রক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালইয়ের শিক্ষার্থীরা। ছাত্ররা সেই আন্দোলনে পরাজিত হলেও নৈতিক জয় ছিলো ছাত্রদেরই। প্রকৃত পরাজয় হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাবলম্বী করে তোলার বিদেশী পরামর্শ বাস্তবায়নে ক্লাসরুমগুলোকে ব্যবহারের দারুণ সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায়নি। ক্রমাগত অস্থিতীশীল চাকরির বাজারে, ক্রমবর্ধমান সনদের চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পয়সার বিনিময়ে সনদ বিক্রির লোভনীয় প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে তাই মরিয়া হয়ে ওঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ২০১৪ সালে বেশকিছু বিভাগে ইভনিং মাস্টার্স চালু করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রশাসন। চাহিদার বিপরীতে অপ্রতুল অবকাঠামো, মানহীন এবং অপর্যাপ্ত শিক্ষকের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের করুণ দশায় যারা কখনও সেসবের সমাধানে উফঃ পর্যন্ত করেনি, তারা ক্লাসে ক্লাসে সান্ধ্যকোর্সের পক্ষে বয়ান হাজির করতে থাকে, সান্ধ্যকোর্সের অতিরিক্ত আয় দিয়ে বিভাগগুলোর উন্নয়ন হবে, শ্রেণিকক্ষের আধুনিকায়ন হবে ফলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। অথচ ধূর্ত শিক্ষকেরা তর্ক এড়িয়ে যান, ক্লাসের ডিজিটালাইজেশান মানেই শিক্ষার উন্নয়ন নয়। এক্সট্রা কোর্সের লেকচার প্রস্তুত, ক্লাসে সেগুলোর ডেলিভারিতে অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের ফলে নিয়মিত কোর্সের কার্যক্রমে অমনোযোগী হয়ে পড়া, অপ্রতুল কাঠামোয় আরও শিক্ষার্থীর চাপ সমস্যাগুলোকে প্রকট করে তোলার হুমকি, সাধারণ ডিগ্রি পাশের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ডিগ্রি চাকরির বাজারে যোগ্যতার ভারসাম্য ব্যাহত করা এবং সনদ বিক্রির পয়সা পকেটস্থ করার লোভে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সওদার পদক্ষেপের বিশাল তর্ক সেসব পন্ডিত শিক্ষকেরা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। ফলে সচেতন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজেদের করণীয় ঠিক করতে দেরি হয়না। সবচে প্রান্তিক, ন্যূনতম আয়ের যেকারো উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্যেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি, পয়সার বিনিময়ে শিক্ষা নীতিতে তাদের বেশিরভাগের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বিনষ্ট হবার সিদ্ধান্তকে তাই তারা প্রত্যাখ্যান করে আত্মমর্যাদার সাথে। নেমে আসে রাস্তায়। সান্ধ্যকোর্স বন্ধে প্রশাসনকে আল্টিমেটাম দেয়, স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু ব্যবসায় নীতির প্রশাসন পয়সার লোভকে উপেক্ষা করতে পারেনি ফলে ছাত্রদের সাথে তাদের মতবিরোধ স্পষ্ট হয়। বেনিয়া প্রশাসন তাই অধিকতর টিউশন ফি আরোপ করে পুনরায় আরেকটি নীতি গ্রহণ করে।
২রা ফেব্রুয়ারি, প্রশাসন ভবন ঘেরাও করে ছাত্রদের বিক্ষোভ। ছবিঃ গোলাম মোস্তফা


আত্মমর্যাদাশীল ছাত্ররা টিউশন ফি প্রত্যাহার, সান্ধ্যকোর্স বাতিল চেয়ে ছাত্র বিক্ষোভের ডাক দেয়। যদিও প্রশাসন দুদফা ছাত্রদের সাথে বসতে আগ্রহী হয় কিন্তু পয়সার লোভ তারা উপেক্ষা করবেনা বলে সাফ জানিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ছাত্র গণবিক্ষোভ বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত টিউশন ফি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও শিক্ষার সওদাগিরি অব্যাহত থাকবে এরকম সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় তারা। বিপরীতে ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ থেকে দাবি আদায় ছাড়া আন্দোলন থেকে পিছু হটবেনা জানালে বেনিয়া প্রশাসন লাঠিচার্জের সিদ্ধান্ত নেয়। আজকের এই দিনে ২০১৪ সালে দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে চলমান ছাত্র আন্দোলনকে থামাতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়। এবং পুলিশ, ছাত্রলীগের যৌথ হামলার মাধ্যমে ছাত্রদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয় প্রশাসন। পুনঃরায় আন্দোলন সংগঠিত করতে দেবেনা বিধায় সেদিন বিকেলেই অনির্দিষ্টকালের জন্যে ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়। পরদিন আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে সংগঠিত করতে যেসকল রাজনৈতিক সচেতন ছাত্ররা কাজ করেছিলো তাদের এক হাত দেখে নেয় আবারও। ছয়টা মামলা ঠুকে দেয় তাদের বিরুদ্ধে। সেসব মামলা আজ অবধি চলমান। তৎকালীন প্রশাসনের সেসব শিক্ষকদের ছাত্রবান্ধব শিক্ষক হিসেবে এক ধরণের সুনামও রয়েছে। তারা ছাত্রদের বিভিন্ন ইভেন্টে চাঁদা দেন, আতিথ্য গ্রহণ করেন, মিডিয়ার সামনে কথা বলেন। আবার ছাত্রদের দিকে বন্দুক তাক করবার নির্দেশও দেন।

ছবিতে বন্ধুক হাতে ছাত্রলীগ নেতা


বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে পয়সার চেয়ে মর্যাদার মূল্য বেশি এই ধারণাকে তারা পৃষ্ঠ করে প্রমাণ করলেন, পয়সার লোভ তাদেরও আছে। আর সেই পথে কেউ অন্তঃরায় হলে তারাও আভিভূর্ত হতে পারেন সন্ত্রাসের চেহারায়। ২রা ফেব্রুয়ারিতে তাদের সন্ত্রাসী চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। তাই দিবসটা তারা ভুলে যাবেন। কিন্তু ছাত্ররা সেটি স্মরণ করবেন যুগ যুগ ধরে। শিক্ষা রক্ষা দিবসের ৭ম বছরে এসে দিবসটিকে আমরা স্মরণ করতে চাই। ছাত্রদের সেদিনের সাহসী, সহিষ্ণু পদক্ষেপ আমাদের অনুপ্রাণিত করে শিক্ষা রক্ষার মিছিলে জোরসে স্লোগান দিতে। আজকের দিনে সেসব আহত ছাত্রদেরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জোরসে বলি, শিক্ষা ব্যবসা নিপাত যাক।