জুতো কেনার জমানো টাকা দিয়ে মদ কিনে ঘরে ফিরলাম। কেরানি জীবনে নবাবি বলতে দর কষাকষি ছাড়াই রিকশায় চেপে বসা‒ আজিমপুর যাবেন?
●
জানালার
সুন্দর সাদা পর্দা, চকচকে দেয়ালের রং, বেতের সোফা‒ এমনিতেই ছোট
ঘর, এতকিছু ঢুকে পড়লে নিজের জায়গাটুকু থাকে না। পয়সা কোথায় সেসব কেনার? নেই। আসবাবহীন
ঘরটাকে নিজের বলে মনে হলো। ইচ্ছে হলে সিগারেটের ছাই ফেলানো যায়, গেলাসে ঢালা যায় লাল
জল, চিপসের প্যাকেট ছুড়ে ফেলা যায় মেঝেতে‒ যেন ছুড়ে ফেলছি ছোটলোক বলে অবহেলা করা তোমারই সে পুরোনো
চিঠি। জন্মদিনে আমাকে লেখা হয়েছিল‒ ‘ভালো বন্ধু।’
দুই
গেলাস শেষ হলো। মাথা এলোমেলো হয়ে আসছে। তবু হৃদয় শান্ত আর ধীর। সব টের পাচ্ছি মনে হলো‒ এখনও তোমারে ভালোবাসি সব অপমানের পরেও। পিঠের দেয়াল থেকে বেরিয়ে এলো তোমারই
ছোটবোন। আমারে সঙ্গ দিতে। বললাম, বেদুইন জীবনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিয়ম করে ঘরে ফেরার
আকাঙ্ক্ষাই তো প্রেম। এখনও জমে আছে হৃদয়ে। আমার কথাবার্তা পাত্তা পেলো না। ‘তুমি একটা
বাজে লোক। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো।’
আয়নায়
নিজেরে দেখলাম‒ পৃথিবীর সবচে সুন্দর চিত্রনাট্য প্লে করা হলো।
বৈশাখের খা খা ভোরে আমার জন্ম। আজান হচ্ছিলো সম্ভবত। সকালের রোদ তীব্র হওয়া অব্দি সবাই আমাকে ঘিরে ছিল। দমবন্ধ লাগছিল। বাবাকে দেখলাম না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। মায়ের জন্যে মন খারাপ হলো। ততক্ষণে হারিয়ে গেছে বাড়ির পথ। আমি বড় হয়ে গেছি মা টেরই পায়নি। রাস্তা খুঁজে হয়রান হলাম। ক্লান্তিও লাগছিল। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। খিদে পাচ্ছিল। সাদা ভাত, ডাল আর নরম বিছানার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হাঁটছিলাম। কেবলই হাঁটছি।
●
ঠিকানা
জানি না তবু থামলাম। নক করলাম। দরজা খোলা হলো। যেন অবগত আমি আসব। তবু বসতে বলা হলো
না। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিচেনে রাখা আছে ভাত-ডাল? সেখানে গেলাম। এঁটো বাসন-কোসন
পড়ে আছে। থালার অভাবে ভাত খেতে দেয়া যাচ্ছে না ভাবলাম। ক্লান্ত তবু ধুয়ে ফেললাম। বড়
থালা। ফুলের ছবি চারপাশ জুড়ে। ভাত বলে মনে হতে লাগল। খিদেও পেয়েছে বেশ। কারও মনোযোগ
পাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। মনে হলো খুব ভিড়ের ভিতর হারিয়ে ফেলেছি মায়ের হাত‒ ‘আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও। খিদে পেয়েছে আমার। বাড়ি গিয়ে ভাত খাব।’
কেউ
শুনলো না। স্ক্রিন চালু হলো। সুর শুরু হলো। সিনেমা শুরু হলো‒ কাজলের দিনরাত্রি।
আমার ক্ষুধার হাহাকার ঢাকা পড়ে গেল। ট্যাপের জলের সাথে মিশে যদি হারিয়ে ফেলা যেত নিজেরে পাতালপুরির দেশে! জলের সাথে নিজেরে মিশিয়ে দিলাম।
●
সবুজ
পুরোনো দেয়াল-ঘেরা ঘরে নিজেকে টের পেলাম। সকাল হয়ে গেছে। বাইরে ঘন কুয়াশা। ক্ষুধা আর
কেরানির জীবন নিয়ে উঠে পড়লাম। একই কিচেন। একই জলের ট্যাপ। সেই ঘর‒ যেখানে পৌঁছেছিলাম ঠিকানা না জেনেই। উঠে পড়তে হলো। যেন কেউ দেখে না ফেলে!
জল গরম করে তড়িঘড়ি স্নান সারলাম। বিষাদের শরীরে গরম জল‒ আহা। লাল জলের কথা মনে হলো। মনে হলো বেরিয়ে পড়তে হবে।
মদ
গেলার ঘটনা মনে পড়ছে না। আসবাবহীন পুরোনো ঘরটা নেই। বোতলটা উধাও।
বাড়ি
থেকে বেরিয়ে এই সকাল‒ মাঝের কিছুই মনে পড়ছে না। জুতো কেনার আকাঙ্ক্ষা, কেরানি
জীবন, মদের বোতল‒ কিছুই মনে পড়ছে না। কেবল টের পেলাম ক্ষুধা।
বেরিয়ে
পড়লাম।
যাযাবর/২০
পৌষ, ১৪২৯

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন