ছাত্র আন্দোলন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ছাত্র আন্দোলন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২রা ফেব্রুয়ারিঃ শিক্ষার সওদায় রাবি প্রশাসনের নগ্ন চেহারা

গুলিতে আহত শিক্ষার্থী


২রা ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের আজ ১১ বছর। হামলাকারী প্রশাসন ও তার সহযোগীদের করা ছয়টা মামলা এখনও চলমান। বিজ্ঞ আদালত ইতোমধ্যে দুটো মামলায় ছাত্রদের পক্ষে রায় দিয়েছে বলে জেনেছি। টিউশন ফি প্রত্যাহার আর পয়সার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সের সনদ বিক্রির পাঁয়তারা রুখে দিতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিলো সেদিন। পাঁচ সহস্রাধিক ছাত্রের সেই বিক্ষোভ থামাতে গুলি ছুড়েছিলো তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়েস তখন তেতাল্লিশ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাইভেটাইজড করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ছাত্ররা বিক্ষোভ করছিলো সেদিন। কিন্তু প্রশ্নটা যে সওদাগিরির! পয়সা কামানোর! পয়সার প্রশ্নে তাই ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দিতে ভুল হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। পুলিশ আর ছাত্রলীগকে দিয়ে ঘৃণ্য হামলা চালায় নিরীহ ছাত্রদের উপর। ব্যাপক হামলা, ছররা বুলেট, রাবার বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয় ছাত্রদের পিঠ। ১২ জন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়, আহত হয় শতাধিক। [প্রকৃতপক্ষে, হতাহতের সংখ্যা কয়েকশো বলে ধারণা করা হয়]

হামলা থেকে নিজেদের বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে শিক্ষার্থীরা
শিক্ষার সওদাগর ততকালীন প্রশাসনের নগ্ন চেহারা উন্মোচিত হয়েছিলো সেদিন, ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ তারিখে। দিবসটির আজ সাত বছর। বিগত ছয় বছর ধরে দিবসটিকে শিক্ষা রক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালইয়ের শিক্ষার্থীরা। ছাত্ররা সেই আন্দোলনে পরাজিত হলেও নৈতিক জয় ছিলো ছাত্রদেরই। প্রকৃত পরাজয় হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাবলম্বী করে তোলার বিদেশী পরামর্শ বাস্তবায়নে ক্লাসরুমগুলোকে ব্যবহারের দারুণ সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায়নি। ক্রমাগত অস্থিতীশীল চাকরির বাজারে, ক্রমবর্ধমান সনদের চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পয়সার বিনিময়ে সনদ বিক্রির লোভনীয় প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে তাই মরিয়া হয়ে ওঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ২০১৪ সালে বেশকিছু বিভাগে ইভনিং মাস্টার্স চালু করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রশাসন। চাহিদার বিপরীতে অপ্রতুল অবকাঠামো, মানহীন এবং অপর্যাপ্ত শিক্ষকের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের করুণ দশায় যারা কখনও সেসবের সমাধানে উফঃ পর্যন্ত করেনি, তারা ক্লাসে ক্লাসে সান্ধ্যকোর্সের পক্ষে বয়ান হাজির করতে থাকে, সান্ধ্যকোর্সের অতিরিক্ত আয় দিয়ে বিভাগগুলোর উন্নয়ন হবে, শ্রেণিকক্ষের আধুনিকায়ন হবে ফলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। অথচ ধূর্ত শিক্ষকেরা তর্ক এড়িয়ে যান, ক্লাসের ডিজিটালাইজেশান মানেই শিক্ষার উন্নয়ন নয়। এক্সট্রা কোর্সের লেকচার প্রস্তুত, ক্লাসে সেগুলোর ডেলিভারিতে অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের ফলে নিয়মিত কোর্সের কার্যক্রমে অমনোযোগী হয়ে পড়া, অপ্রতুল কাঠামোয় আরও শিক্ষার্থীর চাপ সমস্যাগুলোকে প্রকট করে তোলার হুমকি, সাধারণ ডিগ্রি পাশের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ডিগ্রি চাকরির বাজারে যোগ্যতার ভারসাম্য ব্যাহত করা এবং সনদ বিক্রির পয়সা পকেটস্থ করার লোভে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সওদার পদক্ষেপের বিশাল তর্ক সেসব পন্ডিত শিক্ষকেরা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। ফলে সচেতন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজেদের করণীয় ঠিক করতে দেরি হয়না। সবচে প্রান্তিক, ন্যূনতম আয়ের যেকারো উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্যেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি, পয়সার বিনিময়ে শিক্ষা নীতিতে তাদের বেশিরভাগের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বিনষ্ট হবার সিদ্ধান্তকে তাই তারা প্রত্যাখ্যান করে আত্মমর্যাদার সাথে। নেমে আসে রাস্তায়। সান্ধ্যকোর্স বন্ধে প্রশাসনকে আল্টিমেটাম দেয়, স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু ব্যবসায় নীতির প্রশাসন পয়সার লোভকে উপেক্ষা করতে পারেনি ফলে ছাত্রদের সাথে তাদের মতবিরোধ স্পষ্ট হয়। বেনিয়া প্রশাসন তাই অধিকতর টিউশন ফি আরোপ করে পুনরায় আরেকটি নীতি গ্রহণ করে।
২রা ফেব্রুয়ারি, প্রশাসন ভবন ঘেরাও করে ছাত্রদের বিক্ষোভ। ছবিঃ গোলাম মোস্তফা


আত্মমর্যাদাশীল ছাত্ররা টিউশন ফি প্রত্যাহার, সান্ধ্যকোর্স বাতিল চেয়ে ছাত্র বিক্ষোভের ডাক দেয়। যদিও প্রশাসন দুদফা ছাত্রদের সাথে বসতে আগ্রহী হয় কিন্তু পয়সার লোভ তারা উপেক্ষা করবেনা বলে সাফ জানিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ছাত্র গণবিক্ষোভ বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত টিউশন ফি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও শিক্ষার সওদাগিরি অব্যাহত থাকবে এরকম সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় তারা। বিপরীতে ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ থেকে দাবি আদায় ছাড়া আন্দোলন থেকে পিছু হটবেনা জানালে বেনিয়া প্রশাসন লাঠিচার্জের সিদ্ধান্ত নেয়। আজকের এই দিনে ২০১৪ সালে দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে চলমান ছাত্র আন্দোলনকে থামাতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়। এবং পুলিশ, ছাত্রলীগের যৌথ হামলার মাধ্যমে ছাত্রদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয় প্রশাসন। পুনঃরায় আন্দোলন সংগঠিত করতে দেবেনা বিধায় সেদিন বিকেলেই অনির্দিষ্টকালের জন্যে ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়। পরদিন আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে সংগঠিত করতে যেসকল রাজনৈতিক সচেতন ছাত্ররা কাজ করেছিলো তাদের এক হাত দেখে নেয় আবারও। ছয়টা মামলা ঠুকে দেয় তাদের বিরুদ্ধে। সেসব মামলা আজ অবধি চলমান। তৎকালীন প্রশাসনের সেসব শিক্ষকদের ছাত্রবান্ধব শিক্ষক হিসেবে এক ধরণের সুনামও রয়েছে। তারা ছাত্রদের বিভিন্ন ইভেন্টে চাঁদা দেন, আতিথ্য গ্রহণ করেন, মিডিয়ার সামনে কথা বলেন। আবার ছাত্রদের দিকে বন্দুক তাক করবার নির্দেশও দেন।

ছবিতে বন্ধুক হাতে ছাত্রলীগ নেতা


বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে পয়সার চেয়ে মর্যাদার মূল্য বেশি এই ধারণাকে তারা পৃষ্ঠ করে প্রমাণ করলেন, পয়সার লোভ তাদেরও আছে। আর সেই পথে কেউ অন্তঃরায় হলে তারাও আভিভূর্ত হতে পারেন সন্ত্রাসের চেহারায়। ২রা ফেব্রুয়ারিতে তাদের সন্ত্রাসী চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। তাই দিবসটা তারা ভুলে যাবেন। কিন্তু ছাত্ররা সেটি স্মরণ করবেন যুগ যুগ ধরে। শিক্ষা রক্ষা দিবসের ৭ম বছরে এসে দিবসটিকে আমরা স্মরণ করতে চাই। ছাত্রদের সেদিনের সাহসী, সহিষ্ণু পদক্ষেপ আমাদের অনুপ্রাণিত করে শিক্ষা রক্ষার মিছিলে জোরসে স্লোগান দিতে। আজকের দিনে সেসব আহত ছাত্রদেরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জোরসে বলি, শিক্ষা ব্যবসা নিপাত যাক।