আমরা তিন ভাইবোন। শিউলির পরে আমি, তারপর ছোট বোন শিল্পী। ছোটবেলায় শিউলি ছিল দাদির পাগল। এত পাগল যে, ওকে ছাড়া দাদি কোথাও যেতে পারত না। খেতে পারত না। পাড়া বেড়াতে পারত না। দাদিকে না পেলে শিউলির যে বিলাপ শুরু হতো তা দেখা যায় না। ছটফট করত। কী যে কান্না করত বলে বোঝানো যাবে না। একবার দাদি শিউলিকে রেখে বাপের বাড়ি বেড়াতে যায়। স্কুল ফেরত শিউলি এসে দাদিকে না দেখে সেই যে কান্না জুড়ল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা-রাত অব্দি। সারা বিকেল ওকে কেউ থামাতে পারেনি।
আমাদের গোরস্তানের পথ ধরে মাঠের রাস্তা। তারপর বড় রাস্তায় মিশে দাদির বাপের বাড়ির পথ। শিউলি দাদির বিলাপে সারা বিকেল ওই পথে ছুটে ছুটে যায়; কেউ ধরে এনে শান্ত করে; কিছুক্ষণ পর আবার পথ ধরে দৌড় দেয়। ‘ও দাদি, ও দাদি…’ সারা বিকেল-সন্ধ্যা এভাবে চলেছে। বিকেলে ওকে কাঁদতে দেখে খেলতে গিয়েছি; মগরেবের সময় এসে শুনি সে আবার মাঠের রাস্তায় দৌড় দিয়েছে‒ দাদির কাছে যাবে। ইদগাহ অব্দি যেয়ে দেখি সে প্রায় বুধোর বাড়ি‒ বড় রাস্তার কাছাকাছি। ওর পাগলপ্রায় দৌড়ানি; দাদি, দাদি বলে চিল্লানো দেখে আমার হাসিই পেল। ওকে ব্যঙ্গ করে মনে মনে বললাম, ‘আমারও তো দাদি। আমি তো দাদিকে ছাড়া দিব্যি থাকতে পারি। বাড়িতে আব্বা আছে, মা আছে; আমরা ভাইবোনেরা আছি। তোর দাদিকে লাগবেই কেন!’ দাদিই ওর পুরো দুনিয়া। বোকা মেয়ে!
কেমন মায়া হলো ওর প্রতি! দাদির প্রতি রাগ হলো। কেন মেয়েটাকে সে না নিয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি!
কুড়ি
বছর পেরিয়ে গেছে। সম্ভবত আরও বেশি। দাদি আজ নেই। শিউলির ছেলেটা ক্লাস এইটে। আজ যদি
ওকে বলতে পারতাম, ‘বু’জান আমার! একটা মানুষ মানুষের হতে পারে পুরো দুনিয়া।’ বুজান,
কার কাছে যেয়ে বলব, কোন পথে দৌড়ে করব এ বিলাপ!
‘বু’জান
আমার! তোকে ব্যঙ্গ করার পাপেই কি আজ খোদা আমার দুনিয়াটা কেড়ে নিল! দাদির মতো একজনই
কেবল নেই; চার কোটি মানুষের ভিড়‒ তবু
মনে হয় খাঁখাঁ বিরানভূমি এ জনপদ। ‘ও বু’জান! আমাকে একটাবার জড়িয়ে ধর আজ।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন