কেন প্রেম হয় মধুর মতন আর ভাঙে হেমলকের ন্যায়?

 অটো থেকে নামলাম। বুঝতে পারছিলাম দেরি করে ফেলেছি। দৌলতপুর থেকে সোনাডাঙা পৌঁছতে দেরি করে ফেললাম অথচ মেয়েটা বাগেরহাট থেকে প্রায় ৫০ কিলো জার্নি করে আমার আগেই এসে পৌঁছেছে। ইতস্তত বোধ হচ্ছিল। ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। অটো ভাড়া পরিশোধ করে তাকালাম রাস্তার অপর পাশে। সোনাডাঙা বাস টার্মিনাল ঘেঁষা বৈদ্যুতিক খুঁটির পাশটায় দাঁড়ানো দেখলাম। সবুজ কলাপাতা রঙের শাড়ি, খোলা চুল, কালো টিপ রাস্তার এপাশ থেকে দাঁড়িয়ে যেন পরীকে দেখছি। কী সুন্দর দেখতে! সামনাসামনি প্রথমবার দেখলাম। আমি পৌঁছে গেছি, সেটা না বলে যদি আরও কিছুক্ষণ দেখে নেওয়া যায়...পৌঁছনোর কথাটি তখনও বলিনি। তবু মুহূর্তেই আমাকে দেখে ফেলল। রাস্তা পেরোলাম। মুখোমুখি দাঁড়ালাম গিয়ে। এত মুগ্ধ যে, কথাই বলতে পারলাম না শুরুতে! কেবল চেয়ে থাকলাম চোখের দিকে। ‘দেরি করেছো! তবে বেশিক্ষণ নয়।’ আমাকে সহজ করে দিতেই বোধহয় বলল কথাটি। কেবল বললাম, ছবির চেয়ে সুন্দর মেয়েটিকে সামনে থেকে দেখছি! ‘বাড়িয়ে বলছ!’


রাস্তা পার হলাম। হাতটা ধরে ফেললাম সাবধানে রাস্তা পার করে দেবার অজুহাতে। অটো ধরলাম। সোনাডাঙা থেকে আমাদের গন্তব্য শিববাড়ি। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা গন্তব্যে অটো নিলাম। পাশাপাশি দুজনে। ৩ মাসের প্রেম দূরত্বের; মুখোমুখি কত কথা বলব বলে ভেবে রাখা সব কথা কোথায় যেন হাওয়ায় মিলিয়েছে। কেবল দেখছি। যেন বিশ্বাস হতে চায় না আমরা পাশাপাশি। কী কথায় যেন আমি লজ্জা পেলে হাসল। হাসলে ওর দাঁতগুলো যেন মুক্তো ছড়ায়। লজ্জা পেলেও ওর হাসি দেখতে থাকলাম। স্বপ্নের মতো অটো ট্রিপ সেরে আমারা নামলাম গন্তব্যে। প্রথম গন্তব্যের স্মৃতিরা নাহয় থাকুক ব্যক্তিগত। কেবল মনে পড়ে ওকে ছুঁয়ে দেবার প্রথম শিহরণ। কেবল মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত সুখ নাজিল হলো আমার ওপর।

বিকেল গড়ালে আমরা গেলাম রূপসা ঘাটে। নদীর পাড় ঘেঁষে বালু ফেলে রাখা, কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ইট, টং দোকান চায়ের, ছাউনির মতো দুয়েকটা ফুচকার দোকান। ‘আমাকে ফুচকা খাওয়াবে?’ ওর সারল্য শাড়িটার মতোই মনে হলো। সবুজ ও কোমল। প্লেটভর্তি ফুচকা খেলাম দুজনে। মনে পড়ে না, ওই বোধহয় জীবনে প্রথম ফুচকা খাওয়া আমার। তারপর থেকে ফুচকারে মনে হতো প্রেমের খাবার। মানুষ প্রেমে পড়লে ওটা খায় সঙ্গীরে নিয়ে।

টং দোকান থেকে চা নিলাম। সব অমিলের মধ্যে কেবল মিল দুজনেরই দুধ চা পছন্দ আমাদের। বিকেল আর রূপসা নদীকে সাক্ষী করে আমাদের প্রথম দ্যাখা লেখা হলো জীবনের খাতায়। সবকিছু স্বপ্ন আর সুখের মতো হতে লাগল। ততক্ষণে বিকেলের আলো মৃদু হয়ে এসেছে। ‘বাসায় দেরি হবে না?’ আমি বললাম। ‘হোক। থাকি না আরও কিছুক্ষণ।’ ‘থাকার সময়টুকু নাহয় এগিয়ে দিয়ে আসি?’ নিষ্পাপ মুখের সে হাসিটুকু চোখ বুজলে এখনও দেখতে পাই। রূপসা ঘাট থেকে রিকশা নিলাম আমরা। গন্তব্য সোনাডাঙা বাস টার্মিনাল।

সোনাডাঙা পৌঁছতে মাগরেব পড়ে গেছে। বাগেরহাটের বাসের টিকিট নিলাম দুটো। বাস ছাড়ার আগেই যেয়ে বেছে নিলাম পছন্দসই সিট। আস্তে আস্তে বাস ভরল। চলতে শুরু করল। জিরো পয়েন্ট ছেড়ে চলতে শুরু করল নিজের গতিতে। ‘একটা গান শোনাই?’ বলে হেডফোনের একটা স্পিকার ওর কানে গুঁজে দিলাম। সারা পথ অসংখ্য প্রিয় গান ওকে শোনালাম। দুটো স্পিকার দুজনের কানে; আমার কাঁধে ওর মাথা। কখন পথ ফুরিয়ে গেল না চাইতেও। বাস থামল বাগেরহাট টার্মিনালে। আমরা নামলাম। ‘আরও এগিয়ে দিই?’ আমি বললাম। ‘না,’ ও বলল, ‘এটা আমার এলাকা। কোনো দরকার নেই।’ রিকশা ডেকে দিতে চাইলাম। না করল। ‘রাস্তা পার হয়ে আমি ডেকে নেব। এটা রাখো।’ একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল হাতে। ‘আমি যাবার পর খুলবে। বিদায় দাও। আসি।’

আফরিনকে বিদায় দিলাম। ওকে কিছুই দিইনি ভেবে কেমন অস্বস্তি হলো। ব্যাগটা খুললাম। এক অন্য উত্তেজনা। দুটো বই, ফুলের বাক্স, একটা মোড়ক, ছোট কাপড়ের আরেকটি ব্যাগ। মোড়কে গোল্ডলিফের প্যাকেট। ফুলের বাক্সে চিঠি ‘দিনে ৫টার বেশি নয়; সবচেয়ে খুশি হবো বাদ দিলে, যদিও একবারে ছাড়তে বলছি না। এবং আরও প্রেম...’ কাপড়ের ব্যাগটায় সানগ্লাস ব্রাউন কালারের। মেয়েটি পুরোদস্তুর আমাকে মুখস্থ করে নিয়েছে মনে হলো। কলাপাতার সবুজ শাড়ি, গোল্ডলিফের প্যাকেট, ব্রাউন কালারের সানগ্লাস, আর সবশেষে কবিতার বই জীবনান্দের! আহা!

সবটুকু চিনে নিয়েছে আমাকে। এত অবাক হলাম বোঝানো যাবে না! গোল্ডলিফ সিগারেট খাই, এটা কি কোনাদিন জিজ্ঞেস করেছিল! মনে পড়ে না। দরকারও নেই। খুশি নিয়ে বাসে চড়লাম আবার...আজ সেসব শুধুই স্মৃতি।

আফরিন! হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন, মাই লাভ! বলতে পারো, কেন প্রেম হয় মধুর মতন আর ভাঙে হেমলকের ন্যায়?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন