poetry/sumon/morol/ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
poetry/sumon/morol/ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

তবু বোধ এক মানুষের— কী হয় কী হয়

দুই যুগ আগের কথা। ক্লাস টু-তে পড়ি তখন। একদিন মার্বেল খেলায় মাসুদকে শায়েস্তা করার জন্য খেলায় না পেরে ওর ঘড়িটা পকেটে পুরে নিলাম। প্রতিদিন আমার ও অন্যদের সব মার্বেল জিতে নেয়া মাসুদ— চাচাতো ভাই ও বন্ধু। গতরে শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান ওর সাথে না পারি মার্বেল খেলায়, না পারি ডাংগুলিতে, না পারি ফুটবলে। সেদিন কী মনে হলো, খেলায় নে মার্বেল জিতে— খেলা শেষে টের পাবি প্রিয় ঘড়ি হারানোর মজা। টানটান উত্তেজনায় সবার খেয়াল ৪২ গুটির মার্বেল ময়দানে। হাতে লম্বা মাসুদই জিতবে দান। তারপর বলবে, ‘আজ আর খেলব না।’ মজা দেখবি তখন। ঘড়ি না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যাবি আজ। অনুমানই হলো সত্যি। ৩ বারের ঘুরে যাওয়া দান জিতে লাফিয়ে উঠল মাসুদ। থলের মধ্যে সব মার্বেল ভরে বলে উঠল, ‘আজ আর নয়। মা মারবে দেখলে। চললাম।’ মাসুদকে কেউ কেউ থামানোর চেষ্টা চালাতে আমি ঘড়িটা লুকিয়ে ফেললাম কায়দা করে। হট্টগোল হলো। খেলা হলো বন্ধ। চলল যে যার মতন। মার্বেল খোয়া গেলেও বিজয়ী মাসুদের আগমনী মন খারাপে ভেতরে তাই শয়তানি আনন্দ। পথ এগোনোর ভান করেও তাই না এগিয়ে চলেছি। মাসুদ উঠল লাফিয়ে। ‘আমার ঘড়ি।’ ‘কী হলো, ভাই? আমি মুখ ফিরালাম। ‘মার্বেল খোয়া গেল তোরও?’ ‘ঘড়িটা পাচ্ছি না।’ মুহূর্তেই কেঁদে ফেলল মাসুদ। ‘এখানেই রেখেছিলাম।’ গতরে স্বাস্থ্যবান ছেলেটির ওভাবে মুহূর্তে মুষড়ে যাওয়া মনের ভিতরে বইয়ে দিল আনন্দ। আগেভাগেই ঘড়ি খোঁজার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলাম। ‘এই দাঁড়াও সবাই।’ আমি হাঁক দিলাম। ‘যারা চোখের আড়াল হয়েছে ডাক সবাইকে।’ 



মার্বেল খোয়ানো পাড়ার ছেলেরা ৫ কি ৬ জন, মাসুদ ও আমি। ‘মাসুদের ঘড়ি পাওয়া যাচ্ছে না।’ সবার উদ্দেশে বললাম। ‘সবার পকেট দেখা হবে,’ বলে মাসুদকেই নির্দেশ দিলাম ঘড়ি খুঁজে বের করার। একে একে সবার পকেট হাতড়ানো হলো। ঘড়িটা নেই। ‘মাসুদ কেন বাদ যাবে?’ আমি বললাম। আরেকজনকে নির্দেশ দিলাম মাসুদের পকেট চেক করার। মাসুদের পকেটেও নেই। মাসুদের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। প্রিয় ঘড়ি হারানোর শোকে কাঁদছে ছেলেটা। এত বেশি দুঃখ দেব ভাবিনি আগে। তার ওপর আমার ভাই। খারাপ লাগার সাথে লাগছে আনন্দ পৈশাচিক। রোজ রোজ খেলায় হেরে আমাদের মন কেমন করে আজ টের পাবে মাসুদ। দুজনকে নির্দেশ দিলাম এদিক-সেদিক খুঁজে দেখার। কোথাও পাবে না জানি। মাসুদের কান্না, দলের ছেলেদের বোকা হওয়ার সাথে আমার মনের পৈশাচিক আনন্দ। 


আনন্দ দীর্ঘ হলো না খুব। কে জানি খবর দিয়েছে মাসুদের মাকে। মরিয়ম চাচী। চাচি আসল লাঠি হাতে। মাসুদকে পেটাবে ভেবে আনন্দ আর বেদনা হলো সমান তালে। চাচি এসে শুনল, ঘড়ি খোয়া গেছে মাসুদের। কিচ্ছু বলল না। একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করে চেক করা হলো আবার। দেখা হলো এদিক-সেদিক। কোথাও নেই মাসুদের প্রিয় ঘড়ি। মাসুদের মা সবাইকে বলল, ‘তোরা কেউ পেলে বাড়িতে দিয়ে যাস। পায়েশ-মাংস রেঁধে খাওয়াব তাকে।’ 


ঘড়ি খোঁজা সাঙ্গ হলে সবাই চলল যে যার মতন। আমি তবু অপেক্ষা করে যাচ্ছি, ছেলেটার মন খারাপ দেখব বলে। চাচি মাসুদকে বলল, ‘তোকে আবার কিনে দেব ঘড়ি। বাড়ি চল বাপ। তোর আর চিন্তা কী! চিন্তা হবে তার, ঘড়িটা যে লুকিয়েছে। হাতে পরতে পারবে না। দু'দিন বাদে ফেরত দেবে, দেখিস।’ 


মা-ছেলের কথোপকথন শুনলাম। ও বয়সে কি আর ওসব কথার মর্মার্থ যায় রে বোঝা! বাড়ি চলে এলাম। ঘণ্টা বাদে গেলাম ঘড়িটার কাছে। যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাতে পরে দেখলাম। ভালোই। বুঝলাম, সকলের সামনে পরা চলবে না। চিনে ফেলবে সবাই। ঘড়িটার হাসিমুখ আর মাসুদের খারাপ লাগা ভেবে আনন্দ হলো আবার। পৈশাচিক আনন্দ। ‘আহা রে মাসুদ! রোজ রোজ আমার হেরে কেমন লাগে টের পাচ্ছিস ভাই!’ মাসুদকে ব্যঙ্গ করলাম। পকেটে পুরে ঘড়িটা চলে এলাম বাড়ি। 


ঘরে ব্যাগের পকেটে রাখলাম। ঘড়িটার প্রতি লোভ নেই। লোভ মাসুদের দুঃখ দেখা। বিকেল হলো। আজান হলো। সন্ধ্যা হলো। মাসুদের দুঃখ পাবার স্মৃতি হলো ম্লান। বোধ হলো, ‘কাজটা ঠিক করিনি।’ কালই কৌশলে ঘড়িটা ফেরত দেবার ব্যবস্থা করা যাবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম। যথারীতি পরদিন স্কুল ফিরে ফেরত দেবার চিন্তা রেখে গেলাম স্কুলে। বোকার মতন ভাবিনি, ওটা প্রতিদিন বেলা ১২টায় এলার্ম দেয়। স্কুল ফেরার পথে টের পেলাম ঘড়িটা মাসুদ বুঝে পেয়েছে। ১২টায় এলার্ম দিচ্ছিল। মা-বোন কেউ টের পেয়ে মাসুদকে ডেকে ফেরত দিয়েছে। মাসুদের সে কী আনন্দ ঘড়ি খুঁজে পেয়ে। বাড়ি ফেরার পথে মাসুদের ঘড়ি বুঝে পাওয়ার ঘটনায় আমার হলো ভয়। ‘আব্বাকে যদি বলে দেয় মাসুদ! কী হবে? মাইর মাটিতে পড়বে না একটাও।’ ভয়ে ভয়ে পা, ভয়ে ভয়ে পদক্ষেপ...

[বহুবছর পর আজ কেন জানি মনে পড়ল ঘটনাটা। মাসুদ, ভাই আমার গল্পটা মনে রেখেছে কি না জানি না। কিংবা অন্য কারো স্মৃতিতে আছে কি না জানা নেই।

৩১ বছরের জীবন-অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মানুষ বুঝে হোক, না বুঝে হোক কিছু ভুল করে ফেলে পরে করে দুশ্চিন্তা, যদি আব্বাকে বলে দেয়! কী হবে তখন! আমি শেষ! ইত্যাদি ইত্যাদি। বলি কী, যদি সুযোগ থাকে তো ঘড়িটা ফেরত দাও। খেলায় হেরে কারো প্রিয় ঘড়ি লুকিয়ে রেখে ক্ষণিকের আনন্দ হয়তো পাবা; একইসাথে আব্বার কানে যাওয়া নিয়ে ভয় তোমাকে পেতেই হবে যদি কাউকে দুঃখ দিতে খেলায় হেরে লুকায়ে রাখো কারো প্রিয় ঘড়ি। 


জীবন এমন রে সোনা, সব ফেরত দেয়। ভালোবাসা ফিরে আসে অন্যরূপে যা আমরা হারিয়ে ফেলি। ফিরে আসে প্রতারণাও। অপেক্ষা করো, আমার জীবনের বোন।]

যীশুর পুনরুত্থান

 




একজন ক্রীশ্চন যেভাবে বিশ্বাস করে— যীশু ফিরে এসেছিল

বাবাও আসবে ফিরে বিশ্বাস করে আড়াই বছরের শিশু
বাবা তার পা হারিয়ে নিরুদ্দেশে
মা তার ঘুমের ঘোরে পুরনো প্রেমিক পোষে।
বহুগামী রাষ্ট্রে হারিয়ে গেলে ফিরে আসে না কিছুই জানে ওই বুড়ো
পুত্রের শোকে যার যায় দিন
স্ত্রীর ক্যান্সার সারবে না জেনেও যেভাবে
মিথ্যের বেসাতি বাড়িয়ে একদিন
বুড়োটা মরবে শিশুটির মায়ের ফুরোবে যৌবন
বাবা আর ফিরবে না ফিরবে না
বড় হয়ে জানবে সে
অথচ একদিন সবই ছিল
পৃথিবীতে ছিল রোববার যীশুর পুনরুত্থান
বড় হয়ে জানবে সে ভালোবাসা এক ভয়ংকর মিথ আর
একদিন পৃথিবীতে প্রেম ছিল।

আমি কি তবে বেঁচে আছি? তবে কি ওঁরা আমাকে মৃত ঘোষণা করলো?

আমি জানি না, আমার অনুপস্থিতিতে আমার সন্তানদের কী অনুভূতি হয়

আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আমাকে নিয়ে কী চিন্তা করেন

মা কাঁদেন কিনা

বাবা দুঃখ করেন কিনা

বন্ধুরা কী সমালোচনা করেন

কমরেডগণ প্রেসের কাছে কী বিবৃতি দেন

সহকর্মীরা আমার ফিরে আসার প্রত্যাশা করেন কিনা


আমি জানি না, তাঁদের কে কী ভাবেন, কী চিন্তা করেন, কার কী দুঃখ বোধ হয়

কিন্তু আমি সবার বিষয়ে জানি আর জানি, আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।


খুব ব্যস্ততার দিনে ধরুন, বুধবারের সকালে।

সন্তানেরা কাঁদছে। স্ত্রী বিলাপ করছে। মা কাঁদছেন অঝোরে। বাবা ঈশ্বরের প্রতি বিরক্তি জানালেন কেন তাঁর আয়ু নিয়ে আমাকে আরও, আরও কয়েকবছর জীবন দান করা গেল না।

বন্ধুদের কেউ ভক্ষণযোগ্য রোস্ট মুখে পুরে দিয়ে যেভাবে বিরোধী দলের সমালোচনা করা হয় সেভাবে কিছু পয়সা পাওয়া যেত। মৃতের ঋণ মওকুফ পুণ্যের কাজ বলে গোরখনন কমিটিকে তলব করলেন একজন। সহকর্মীদের কেউ এত তাড়াতাড়ি! বড্ড তাড়া আমার বলে দুঃখই করলেন বোঝা গেল।

শৈশবের প্রিয় বন্ধুর চোখে জল নেই। কীভাবে আরও সুন্দরভাবে কবরটি খোঁড়া যায় তদারক করছে। একজন ইমামকে আনতে গেছে। বরই পাতা, গোলাপ জল নিয়ে ব্যস্ত কেউ কেউ।

কয়েকজন কমরেড এসেছেন। মুখের পর্দা সরানো হলো আমার দিকে তাকালেন। দুজনের চোখের কোনায় জল। তিনজন প্রতিবেশীদের সাথে দাফন নিয়ে আলাপে আগ্রহী হলেন।

গোসল সম্পন্ন হয়েছে। জানাযার আগে ছোট চাচা জানালেন, পাওনা তাঁর কাছে চাইতে।

নিজের কাছে আমারও কিছু পাওনা ছিল।


[আমি ছিলাম ঘুমকাতুরে। তার জন্যে মা আমাকে বকতো খুব। বাবা বলতো, আমার কখনও উন্নতি হবে না। ঘুমের জন্যে ক্যারিয়ার, ঘুমের জন্যে সংসার, ঘুমের জন্যে স্ত্রীর সাথে বিরোধ, সন্তানের অভিমান আরও কত কী! এমনই এক বুধবারের সকাল নটায়; আমি ছিলাম ঘুমে কান্নার শোরগোল।]

রাতের ব্যাকপেইন কিছুটা আছে। তার মানে? আমি মরিনি?

আমি কি তবে বেঁচে আছি? তবে কি ওঁরা আমাকে মৃত ঘোষণা করলো?


দেহটাকে শুইয়ে রেখে আমি বাইরে এলাম। সিগারেট ধরালাম। সবকিছু কেমন স্বাভাবিক লাগছে। তবে কি আমি সত্যিই মরিনি? স্ত্রীর ঘরে গেলাম। অফিসে চলে গেছেন।

নিজের বসকে ফোন দিলাম। টাইম ম্যানেজমেন্ট যার নেই তার আর চাকরি নেই বলে তাঁর পিয়ন জানালো

তবে কি আমি জীবিত? নাকি মৃত? নাকি মরে গেছি বহুকাল আগে? নাকি আজ? বুধবারের সকালে। নাকি মরিনি? আমি কি তবে জীবিত?

ক্ষুধা লাগেনি। তবে কি বেঁচে আছি? আত্মাকে যে শুইয়ে রেখে এলাম নিজের ঘরে

নিজের ঘরটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কি আমার নিজের কোনো কামরা ছিল না?

আকাশে ঘোর অন্ধকার। মেঘেদের শোক। তবে কি সত্যিই আমি আর বেঁচে নেই? আমার চোখের জল? তা-ও তো নেই। তবে কী? আমি জীবিত? নাকি মৃত? নাকি মরে গেছি বহুকাল আগে? নাকি অন্যকিছু? বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। ঈশ্বর, আমি কি বেঁচে আছি? তবে আমার প্রার্থনা কবুল করো। আমাকে মিশিয়ে দাও বৃষ্টির ফোঁটায়। শেষ প্রার্থনাটুকু মঞ্জুর করো, প্রিয় ঈশ্বর।

কিংবা আমাকে জানাও, আমি জীবিত। আমি মরিনি। আমি বেঁচে আছি।