ট্রাম্প নাকি বাইডেন? কে জিতলে লাভ?

 

 

বাইডেন আর ট্রাম্পের মাঝে কে জিতলো, তাতে আমাদের কী?
কিছুটা কিন্তু বটেই। দুনিয়াতে যে দেশটি আপাত-ক্ষয়িষ্ণু হলেও রাজত্ব করছে, তাকে শাসন করবেন কে, সেটার গুরুত্ব নেই?
 

গুরুত্বটা বহু দিক থেকে। বাইডেন কিংবা ট্রাম্প দুজনেই তাদের দেশের পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তারা যে প্রয়োজনে সারা দুনিয়ায় যুদ্ধও চাপিয়ে দেবেন, সেটা অতীতের বহু 'উদারনৈতিক' রাষ্ট্রপতির আমলেও দেখেছি আমরা। কিন্তু শুধু এটুকু বোঝাই যথেষ্ট না।
সারা পৃথিবীর মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরুপ যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সেটাতে ট্রাম্প বিশ্বাস করেন না। তার দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে আসা মানে বুঝতেই পারছেন, আমাদের দেশেও বাড়তি ঘূর্ণিঝড়, কিংবা বিশ্বজুড়ে প্রাণের অস্তিত্ব আরেকটু বিপন্ন হওয়া। আমার প্রিয় অধ্যাপকদের একজন, কামরুল হাসান মামুন স্যার যেমন বলেন, ট্রাম্প বোকা এবং স্বার্থপর। কেউ একইসাথে এই দুটো হলে সে হয় দারুণ রকমের ক্ষীণদৃষ্টির লোক। নগদস্বার্থ ছাড়া অন্য কিছুতে তার আগ্রহ নাই।
অন্যদিকে বাইডেনের বিকল্প জ্বালানিতে আগ্রহ পরিবেশবাদীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনেরই একটা ফল। বাইডেন ইতিমধ্যেই টেক্সাসে ফ্রাকিং- এ ভর্তুকি বন্ধ করে দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তার একটা উদ্বেগ হলো ট্রাম্প বিকল্প জ্বালানি উৎসগুলোকে গুরুত্ব না দিতে থাকলে চীন সহ অন্যান্য দেশগুলো এক্ষেত্রে প্রযুক্তিসক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে এগিয়ে যাবে।
 
সৌরশক্তি এবং অন্যান্য বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের শক্তিধর রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মাঝে অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয়। এটা এমনকি বিশ্বরাজনীতিতেও কৌশলগত বহু ক্ষেত্রে বদল নিয়ে আসতে পারে, বদল আনেত পারে বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্যেও।
কমলা হ্যারিস সিনেটর হিসেবেই ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। জানি না এটা বাস্তবায়ন করা বা চাপ প্রয়োগ করা কতদূর সম্ভব তার পক্ষে, কারণ সেটা নির্ভর করে আরও অনেকগুলো শর্তের ওপর। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যাবে মোদীর কথাই, সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নিষিদ্ধ তালিকায় ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি সেখানে স্বাগতই হয়েছিলেন। রাষ্ট্রনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রপ্রধানরা বহুক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত মতামত চেপে রাখেন, এটুকু সত্যি। অন্যদিকে প্রকাশ্য প্রশংসা না পাওয়া বা ব্যক্তিগত পাত্তা না মেলা গরিব দেশগুলোর হিংস্র নেতৃত্বের দেবতার ভাবমূর্তি গড়ে ওঠাকে কখনো কখনো কঠিন করে দেয়।
 
 

 
চীন নিয়ে ট্রাম্প কিংবা বাইডেন কারও পক্ষেই কঠিন না হয়ে উপায় নেই। পুঁজিবাদ মানে প্রতিযোগিতা। মুক্ত বাজার প্রতিদিনই আজকের চীনের জন্য উত্তোরোত্তর সুবিধাজনক হয়ে উঠতে থাকবে। ফলে চীনের প্রশ্নে মার্কিন বাণিজ্যস্বার্থগুলোকেও নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতে হবে। মার্কিন পুঁজিপতিরা চীনে পণ্য বানাবেন সস্তা শ্রম ও অন্যান্য অবকাঠামোর লোভে, নাকি নিজেদের দেশে শিল্প ফেরত আনবেন ? প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিনিয়োগ বাড়বে? মার্কিন কর্মসংস্থানের কী হবে?
,মার্কিন নীতি বহুক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় থাকে রাষ্ট্রপতি যেই হোক। কিন্তু অন্যদিকে এই ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়েই কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার এসেছে, নাগরিক অধিকার এসেছে, বহু রাজ্যে মৃত্যুদণ্ড রদ হয়েছে, পরিবেশ রক্ষায় বহু আইন হয়েছে। আবার সেই অর্জনগুলো যে বাতিল হয়ে যাওয়া সম্ভব, সেটাও ট্রাম্পের আমলেই আমরা দেখেছি। ফলে যেই আসুক, সব কিছু অনড়অচল থাকে, এইটা এক রকমের স্থুল চিন্তার ফল।
 
অন্য এ্কটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আগেরবার ট্রাম্প অচেনা ছিলেন, এবার চেনা। কিন্তু এই লোকটির জন্য প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মার্কিনী যে ভোট দিলেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একশো বছর আগেকার কোন কোন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রীতিমত এমন এক ধরনের ধার্মিক ছিলেন, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ বা কমুনিস্টকে গণপিটুনিতে হত্যা করা অনুমোদিত ছিল। একটা বিখ্যাত ঘটনাতে নিহত এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের বিষয়ে এফবিআই গণমাধ্যমে প্রচার করে, সে কমুনিষ্ট ছিল! এটুকুই আসলে যথেষ্ট ছিল এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে সামাজিক অনুমোদন প্রদানের জন্য। আমাদের চেনা সময়ের বুশ কিংবা নিক্সন কিন্তু সেই ধরনের উগ্র খৃস্টান নন, যদিও যুদ্ধবাজ বুশের ধার্মিকতা সুবিদিত ছিল। কিন্তু মার্কিন সমাজে উগ্রধার্মিকতা ও বর্ণবাদ নতুন একটা পুনপ্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে, ভোটারদের আচরনে সেটার বেশ খানিকটা ছাপ রয়েছে।
বঙ্গবাসী ম্যাখোঁদের যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে বলা উচিত ছিল যে, এটা খৃষ্টান ধর্মের সমস্যা। বঙ্গীয় উগ্র প্রাচ্যবাদীরা কিন্তু এটাকে খৃস্টধর্মের সমস্যা হিসেবে, বা অপরিবর্তনশীলতা হিসেবে দেখবেন না, কেননা যে প্রশিক্ষণটি তারা পেয়ে থাকেন, সেই প্রাচ্যবাদী ধারণাগুলোতে পশ্চিমা খৃস্টান জনগোষ্ঠীর এমন প্রবণতার তেমন কোন ব্যাখ্যা আসলে নেই। তাদের আগ্রহ মূলত পূবের মানুষের জগদ্দল পাথরের মত অপরিবর্তনশীলতা নিয়ে।
 


 
কিন্তু আমাদের তো মনে রাখতে হবে যে, মার্কিন সমাজের এই বিপুল প্রতিক্রিয়াশীলতার উৎস খৃষ্টধর্ম নয়। এটা যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের সময়ের মধ্য দিয়ে দেশটি যাচ্ছে, তার পরিনাম, সেটাই এর সত্যিকারের উৎস। দুনিয়া জুড়ে রাজত্ব ও প্রভূত্ব করেছে দেশটি, সেটাই ছিল তার জনগণেরও বিপুল ফূর্তির উৎস। 'মার্কিন স্বপ্ন' বেশ খানিকটা ফিকে হয়েছে, তারই ফলাফল একদিকে স্যান্ডার্সের মত ব্যক্তিদের অভাবনীয় উত্থান, স্যান্ডার্সের এই মতগুলো প্রচার করলে ৬০ বছর আগে তার গুপ্ত হত্যা বা অন্তত কারাবাসের সম্ভাবনা ছিল। এর ফল আরেকদিকে প্রবল বিদ্বিষ্ট রাজনীতি, আজগুবি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও নানান বর্ণবাদী প্রবণতার বিকাশ। সন্দেহতাতীতভাবেই সামনের দিনগুলোতে এই ডানপন্থাকে রাজনৈতিকভাবে দানা বাধতে আরও বেশি করে আমরা দেখবো, যদি না মার্কিন সমাজ তার নিজস্ব রাজনীতি-অর্থনীতিকে বিশ্বমোড়লের ভূমিকা থেকে অনেকটা সরিয়ে নতুন করে পুনর্গঠন করতে না পারে। বাইরের সাম্রাজ্য আগের মত নেই, এটা ধরে নিয়েই তাকে নিজেকে পুনসজ্জিত করতে হবে।
বাইডেনের সীমা বলতে যদি কিছু থাকে, সেটা এইখানে। কোন কারণ নেই তিনি বা তার মতের 'উদারনীতিবাদী'রা এই সঙ্কটগুলোর সমাধান দিতে সক্ষম। ফলে ট্রাম্প-বাইডেন যে আক্রমণাত্মক বনাম উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন, তাদের উভয়টিই মার্কিন সমাজের মৌলিক সঙ্কটগুলোকে সমাধা করতে ব্যর্থ হবার কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সম্ভবত আরও বহু রকমের উগ্রতার বিস্তার আমরা দেখতে পাবো, আশা করি স্যান্ডার্সের মত মানুষদেরও আমরা সেখানে খুঁজে পাবো।
 
By- Firoz Ahmed
Gonosamhati Andolon, Bangladesh

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন