‘ক্ষমা’ এমন একটি শব্দ যেটি শুনতে মহান ও হিলিংয়ের মতো কিছু একটা মনে হয় যতক্ষণ না তোমার নিজেকে সেটি সত্যিই কখনো করতে হয়। নির্মম সত্য এই— কিছু আঘাত আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই থাকে যেটি কখনোই সময়ের সাথে মুছে যায় না। কিছু ক্ষত থাকে এমন জেঁকে বসে থাকে বুকের গভীরে, প্রিয় বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতার ভয়াবহ স্মৃতি বারবার হাজির হয় চোখের সামনে। এসবের পরে যখন কেউ বলে, ‘ক্ষমা করে দাও। সামনে এগিয়ে যাও।’— তারা হয়তো পুরোটা জানে না কিন্তু এমন কি মনে হয় না তখন— ‘সামনে এগোবো? কোথায় সেই সম্মুখের পথ? এটি কি সেই বিকল্প বাস্তবতা যেটি ঘটেইনি এখন পর্যন্ত?’
‘যা কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় সেটিকে ক্ষমা করা’ বলতে জোর করে ক্ষমা করা বা ক্ষমা করে দেওয়ার ভান করা নয় যে, কিছুই ঘটেনি তেমন। এটি এমন— সেই কষ্টের ভেতর দিয়ে অনবরত হাঁটা কিন্তু সেটিকে কখনোই নিজের পরিচয়ের অংশ হতে না দেওয়া। এটি হিলিং হওয়ার একটি প্রক্রিয়া— কারো অনুতপ্ত হওয়ার আশায় বসে না থাকা যেটি কখনোই আসবে না। এটির মানে এই— বুঝতে পারা যে, কেবল ‘সব ঠিক আছে’ বলা নয় বরং বলা যে, ‘এটিকে আর কখনোই আমার নিজের ওপর কর্তৃত্ব করতে দেব না।’
লরেন্স— এক নাটকীয় কায়দায় যার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে সম্প্রতি, আমাকে শিখিয়েছে— ‘অতীতকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তোমার সংগ্রাম করে যাওয়া আবার মনের মধ্যে পুরনো ক্ষোভ পুষে রাখা যে, একদিন কোনো জরুরি মুহূর্তে সেটি খরচ করবে বলে ভেবে থাকো তাহলে আজই সেসব বন্ধ করো। বরং অনুসরণ করো ক্ষমা সম্পর্কিত মহান মনীষীদের শিক্ষা’— লরেন্সের শেখানো এই সাতটি শিক্ষা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। প্রিয় বন্ধুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সকলের জন্য এটি শেয়ার করলাম।
১. এটি ভাবার দরকার নেই যে, ক্ষমা করে দেওয়া মানে যা ঘটেছে তা ঠিক ছিল: আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষমা করতে দ্বিধাবোধ করে কেননা তারা মনে করে, ক্ষমা করা মানে অতীতের ভুল-অন্যায়কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। লরেন্স আমাকে বুঝিয়েছে— ক্ষমা করা মানে অন্যায়কে সমর্থন করা নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনার ন্যায্যতা, সঠিকতা দেওয়ার জন্য ক্ষমা করা নয় বরং সেটির কারাগার থেকে নিজেকে মুক্ত করাই হলো ক্ষমা করে দেওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য। ক্ষমা করে দেওয়ার মানে তাদেরকে দায়মুক্ত করে দেওয়া নয় বরং সেই কারাগার থেকে, সেই কষ্ট বয়ে বেড়ানোর শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করা।
২. ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য কারো অনুতপ্ত হবার আকাঙ্ক্ষা মানে একই কারাগারে আটকে থাকা: আঘাতকারীরা তাদের ভুল বুঝে যদি দায় স্বীকার করত তাহলে ব্যাপারটা সহজ হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই— যারা ক্ষতি করে তারা কখনো সেটা বুঝতেই পারে না। যদি-বা বোঝেও তাদের দুঃখপ্রকাশ আমাদের কষ্ট মুছে ফেলার জন্য যথেষ্ট নয়। লরেন্স আমাকে শিখিয়েছে— হিলিং ব্যাপারটি অন্যদের দুঃখ প্রকাশের সাথে সম্পর্কিত নয়। নির্ভরও করে না তার ওপর। যদি এমন হয় যে, কেউ এসে সেই ক্ষত সারিয়ে দেবে বলে আমরা অপেক্ষা করছি তাহলে কেবল আটকে থাকাই হবে। এটি সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয়— নিখুঁতভাবে এটি বলা নয় যে, দিলাম ক্ষমা করে।
৩. ক্ষমা আর বিশ্বাস এক নয়: ক্ষমার সবচেয়ে কঠিন দিকগুলোর একটি— এরপর কী করা উচিত সেটি বুঝতে পারা। সেইসব মানুষদের আবার জীবনে স্থান দেব? সম্পর্ক ঠিক করে নেব? নাকি একটি স্থায়ী সীমারেখা টেনে সামনে এগিয়ে যাব? লরেন্স আমাকে বলছিল যে— ক্ষমা করা হয় কিন্তু বিশ্বাস অর্জনের বিষয়। কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার মানে এই নয় যে, তাদেরকে আবার জীবনে স্থান দিতে হবে। ক্ষমা মূলত মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য, ইতোমধ্যে বন্ধ করে ফেলা দরজা পুনরায় খুলে দেওয়ার জন্য নয়।
৪. ক্ষতগুলো কখনোই জাদুর মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না, আর সেটিই স্বাভাবিক: ক্ষমা করে দেওয়া মানে ভুলে যাওয়া নয়। জীবনে কিছু আঘাত এমন যা চিরকাল অনুভূত হবে। কিন্তু এটি কোনো ব্যর্থতার চিহ্ন নয় বরং এটি অনুধাবন করায় যে, আমরা মানুষ। হিলিংয়ের জার্নি বারবার বিশৃঙ্খল হতে পারে— কখনো মনে হবে আমরা মুক্ত; কখনো মনে হবে পুরনো ক্ষত জাগ্রত হয়েছে বুকের ভেতর, কখনো সেটি আঘাত হানবে প্রথমবারের ন্যায়, দগদগে হবে কখনো কখনো। ক্ষমা মানে এই নয় যে, তুমি আর কখনো কষ্ট অনুভব করবে না। এটির মানে এই— সেই কষ্টের মধ্যে আটকে থেকে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত না নেওয়া।
৫. বাউন্ডারি সেট করা মানে প্রতিশোধ নয়;
আত্মসম্মানের প্রকাশ: ক্ষমা করা মানে নিজের
আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়া নয়। বারবার আঘাত পাওয়ার চাইতে দূরে সরে আসা, সীমারেখা
টেনে দেওয়ার অর্থ কোনো নিষ্ঠুরতা নয় বরং এটি আত্মসম্মানের প্রকাশ। লরেন্স আমাকে শিখিয়েছে, নিজেকে
দোষী না ভেবেও নিজের বিকাশের জন্য সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি। কাউকে শাস্তি দেওয়ার
জন্য এটি করা নয় বরং নিজের হৃদয়কে রক্ষার জন্য এটি জরুরি। ‘আঘাতকারীকে ক্ষমা করে দাও,’
লরেন্স বলছিল, তবে নিজেকে এটাও বলো যে, ‘নিজেকে ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি তাই এই আঘাত আর
সহ্য করব না।’
৬. নিজের
হিলিং তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল নয়: আমরা অনেকেই মনে করি, যদি সেই ব্যক্তি বদলে যেত,
দায়িত্ব স্বীকার করত, বা অন্তত স্বীকার করত যে, তারা ভুল করেছে, তাহলে নিরাময়
দ্রুত হতো। লরেন্স এটাকেও চ্যালেঞ্জ করল— ‘তোমার হিলিং আঘাতকারীর হাতে নয়।’ সামনে
এগিয়ে যাওয়া, শান্তি খুঁজে পাওয়া, নিজের বিকাশকে তরান্বিত করা এবং অতীতের কারাগার
থেকে বেরিয়ে এসে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সক্ষমতা সবসময় আমাদের নিজেদের ওপরেই নির্ভর
করে; আঘাতকারীদের ওপর নয়।
৭.
ক্ষমা একটি প্রক্রিয়া, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে কিছু নয়: ক্ষমা করা মানে কোনো এক মুহূর্তে হঠাৎ সব ঠিক হয়ে
যাবে, এমন ভাবা নয়। এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা বারবার নিতে হয়— কখনো প্রতিদিনও।
কিছুদিন হালকা লাগবে, আবার কিছুদিন ক্ষোভ ফিরে আসবে। এটি খুবই স্বাভাবিক।
আমি লরেন্সের
কাছে ঋণী— ও বলছিল, ‘নিজেকে দোষারোপ না করে বরং ধীরে ধীরে মুক্তিকে বেছে নাও;
তিক্ততাকে নয়।’
ভুলতে না পারা বিষয়গুলো ক্ষমা করা মানে মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃস্থাপন করা। পরিস্থিতি বদলানোর অপেক্ষা না করে নিজেকে মুক্ত করার পথ তৈরি করার শিক্ষাদানের জন্য লরেন্সের কাছে আমার চির কৃতজ্ঞতা— ‘আঘাতকারীদের পরিবর্তন তোমার হাতে নয়; কিন্তু তোমার পরিবর্তন তোমার হাতে। ক্ষমা তাদের জন্য নয়— এটি তোমার নিজের জন্য। ক্ষোভ নিচের দিকে টানে— ক্ষমা উন্মোচন করে দেয় মুক্তির বিশাল আকাশ।’
[সঙ্গত কারণেই ফেইসবুকে পোস্ট আকারে লেখা বাদ দিতে চাইছি। বিশ্বাস করি, কিছু মানুষেরা লেখাগুলো পড়েন। সুতরাং লিংক শেয়ার করার অনুরোধ থাকবে।]
Find me here: morolsumon@gmail.com / +880 1911 265040






